সঞ্চয়পত্র কি? সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম

সঞ্চয়পত্র কি এবং সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশের একজন নাগরিক সব ধরনের সঞ্চয়পত্র মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবেন।

আপনি যদি ৫ লক্ষ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে চান তাহলে বিগত আয়বর্ষের আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে।

সঞ্চয়পত্র হলো একটি ফিক্সড ডিপোজিট। দেশের জনগণের ঝামেলা মুক্ত অর্থ বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করার অন্য নাম সঞ্চয়পত্র। বাংলাদেশের নাগরিকরা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকারের নিকট অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে।

আজকের আর্টিকেলে আমরা জানবো “সঞ্চয়পত্র কি, সঞ্চয়পত্র কত প্রকার, বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার এবং সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম সম্পর্কে।

সঞ্চয়পত্র কি? (Sanchayapatra ki)

জাতীয় সঞ্চয়পত্র হলো জনগণের হাতে থাকা সঞ্চিত অর্থ যা জাতীয়ভাবে সংগ্রহ করে দেশে বিনিয়োগ ও বাজেটের ঘাটতি মেটানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে।

সাধারণ জনগণ সঞ্চয়পত্র ক্রয় করে তাদের সঞ্চিত আসল অর্থ সরকারের কাছে জমা রাখে এবং অর্থ জমা রাখার বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের ক্রেতা  নিদিষ্ট পরিমাণে মুনাফা/সুদ পায়।

সরকার জনগণের জমা রাখা এই সঞ্চয় বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে। যার ফলে বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ না করে সঞ্চয়পত্রের অর্থ দিয়ে দেশের উন্নয়ন করতে পারে।

বাংলাদেশ জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় সংগ্রহ করা হয় এবং দেশের জনগণকে একটি ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।

অন্য ভাবে বলা যায়, সাধারণ জনগণের হাতে জমানো টাকা দীর্ঘ সময় ফেলে না রেখে সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগে মুনাফা লাভ করা যায়।

দেশের একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী যেমন নারী, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই আওতায় আসার সুযোগ রয়েছে।

সঞ্চয়পত্র কত প্রকার ও কি কি?

আমাদের বাংলাদেশে বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের মোট ৪ টি প্রকার চালু রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, 

  1. ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র
  2. ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র
  3. পরিবার সঞ্চয়পত্র
  4. পেনশনার সঞ্চয়পত্র

চলুন নিচে থেকে এই চার প্রকারের সঞ্চয়পত্র সম্পর্কে জেনে আসি। 

৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র

বাংলাদেশের সকল নাগরিক এবং সকল শ্রেণীর পেশার লোক আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ৬ষ্ঠ তফসিল অনুচ্ছেদ ৩৪ অনুযায়ী কোন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান ৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন।

৫ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্র একক নামে ৫০ লাখ টাকা এবং যুগ্ম নামে ৬০ লাখ টাকা ক্রয় করা যাবে। তবে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উর্দ্ধসীমা নেই।

৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র

বাংলাদেশের সকল শ্রেনীর নাগরিক ও সমাজসেবা কর্তৃক প্রত্যয়নকৃত সকল অটিষ্টিকদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোন অটিষ্টিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান ৩ মাস অন্ত মুনাফাভিত্তক সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন।

দেশের নাবালক এবং প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যাক্তি একক ভাবে বা যৌথ ভাবে ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন। তবে, নাবালকের ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যাক্তি নাবালকের পক্ষে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করবেন।

পরিবার সঞ্চয়পত্র

পরিবার সঞ্চয়পত্র পরিবারের সাধারণ মহিলা, পুরুষ, শারীরিক প্রতিবন্ধী মহিলা বা পুরুষ এবং যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি এবং যারা আয় করতে অক্ষম তারা পরিবার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন।

অর্থাৎ পরিবারের যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি এবং তারা যদি আয় না করতে পারে তাহলে তারা পরিবার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন। পুরুষ, মহিলা উভয় পরিবার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন। 

পেনশনার সঞ্চয়পত্র

পেনশনার সঞ্চয়পত্র মূলত যারা সরকার চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত রয়েছেন তারা এই পেনশনার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন। এই সকল ব্যাক্তিরা হলো, 

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি বা আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বা কর্মচারী। মৃত চাকরিজীবী পরিবারের পেনশন সুবিধাভুক্ত স্বামী/স্ত্রী/সন্তান। সুপ্রীম কোটের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং সশস্ত বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা।

সঞ্চয়পত্র কিনতে কি কি লাগে ২০২৩

  • সঞ্চয়পত্র ক্রেতার দুই (২) কপি পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি। 
  • ক্রেতার নমিনির দুই (২) কপি পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি, যা ক্রেতা কর্তৃক সত্যয়িত হতে হবে। 
  • প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আয়কর রির্টান দাখিলের প্রামাণপত্র।
  • ক্রেতার ব্যাংক হিসাবের MICR চেক এবং MICR সাদা চেকের কপি।

সঞ্চয়পত্র কোথায় থেকে কেনা যাবে

বাংলাদেশ জাতীয় সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে হলে দেশের ৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় করতে পারবেন। এই প্রতিষ্ঠান গুলো হলো,

  • জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর অধীনস্থ সকল সঞ্চয় বুরো অফিস।
  • ডাকঘর সমূহ। 
  • তালিকাভুক্ত ব্যাংক সমূহ (শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক বাদে)।
  • বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যালয় সমূহ (ময়মনসিংহ এবং ঢাকা সদরঘাট অফিস বাদে)।

বাংলাদেশ ইসলামি ব্যাংক সমূহ বাদে অন্যান্য সকল ব্যাংক থেকে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন। আমার পরামর্শ আপনি যদি জাতীয় সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে চান তাহলে নিকটতম সোনালী ব্যাংক থেকে ক্রয় করতে পারবেন।

সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গানোর নিয়ম ২০২৩

জাতীয় সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গানোর জন্য আলাদা কোনো নিয়ম নেই। নিদিষ্ট মেয়াদ শেষে অটোমেটিক ভাবে আপনার ব্যাংক একাউন্টে মুনাফা বা সুদ সহ মোট সঞ্চয়পত্রের টাকা জমা হয়ে যাবে।

অর্থাৎ মেয়াদ শেষে অটোমেটিক ভাবে আপনার ব্যাংক একাউন্ট টাকা জমা হয়ে যাবে। আপনার ইচ্ছে সময় মতো টাকা তুলতে পারবেন।

আর নিদিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে যদি আপনার ক্রয় করা জাতীয় সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গতে চান তাহলে লিখিত আবেদন করতে হবে।

সঞ্চয়পত্র আয়কর রির্টান

সঞ্চয়পত্র আয়কর জমা প্রদান করার জন্য রির্টার ফরমে ২নং অংশে সিকিউরিটির উপর সুদ হিসাবে সংশ্লিষ্ট আয় বছরের প্রাপ্ত সঞ্চয়পত্রের মোট সুদের পরিমান লিখতে হবে। 

আপনার যদি টিন সার্টিফিকেট থাকে তাহলে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর ১০% হারে কর কেটে নেওয়া হবে। এই করকে অগ্রিম কর হিসাবে দেখিয়ে সঞ্চয়পত্র আয়কর রির্টান জমা দিতে হবে। 

মনে রাখবেন, আয়কর রির্টান দাখিল করলেই যে আপনাকে কর প্রদান করতে হবে বিষয়টা এমন না। সঞ্চয়পত্রের সুদের কর আপনার থেকে আগেই কেটে নিয়েছে। তাই রির্টানে অগ্রিম কত টাকা কর কর্তৃন করা হয়েছে তার পরিমান উল্লেখ করতে হবে।

তাছাড়া আপনার যদি অন্য কোনো করযোগ্য আয় থাকে সেক্ষেত্রে আপনার মোট আয়কর থেকে সঞ্চয়পত্রের আয়কর বাদ দিয়ে বাকি কর পরিশোধ করতে হবে।

নতুন অর্থ বছর ২০২২ অনুযায়ী একজন ব্যাক্তি যদি ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ক্রয় করে তাকে তাকে বিগত করবর্ষের আয়কর রির্টান জমা দেওয়ার রশিদ দেখাতে হবে।

আর আপনি যদি ৫ লাখ টাকার কম সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেন তাহলে আয়কর রির্টান বা টিন সার্টিফিকেটের কোনো কাগজ পত্র লাগবে না।

জাতীয় সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম ২০২৩

বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেওয়া সোনালী ব্যাংক সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম অনুযায়ী একজন নাগরিক সকল ধরনের সঞ্চয়পত্র মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবেন।

পরিবার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার ক্ষেত্রে এক (১) জন নাগরিক তার একক নামে ৫০ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবে না।

নতুন অর্থ আইন ২০২২ অনুযায়ী একজন নাগরিক ৫ লাখ টাকার বেশি পরিমাণে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে হলে বিগত করবর্ষের আয়কর রির্টান জমা দেওয়ার রশিদ দেখাতে হবে।

তবে, কোনো নাগরিক যদি ৫ লাখ টাকার কম সঞ্চয়পত্র ক্রয় করে তাহলে আয়কর রির্টান বা টিন সার্টিফিকেটের কাগজ পত্র দেখাতে হবে না।

সঞ্চয়পত্র সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর

সঞ্চয়পত্র কি হালাল নাকি হারাম?

জাতীয় সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার পরে নিদিষ্ট মেয়াদ শেষে সঞ্চয়পত্রের সাথে অতিরিক্ত মুনাফা বা সুদ দেওয়া হয়। এটা সম্পূর্ণ সুদ তাই সঞ্চয়পত্র অবশ্যই হারাম।

সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বা সুদ কত?

১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ বছরান্তে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বা সুদ ১১.৫২%, ৪ বছরান্তে ১১%, ৩ বছরান্তে ১০.৫০%, ২ বছরান্তে ১০% এবং ১ বছরান্তে ৯.৫০%।

সর্বনিন্ম কত টাকা সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা যায়? 

৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ জাতীয় সঞ্চয়পত্রে সর্বনিন্ম ১০ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা যায়।

নাবালকের নামে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা যাবে কিনা?

নাবালকের নামে জাতীয় সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা যাবে না। 

সঞ্চয়পত্র জামানত রেখে ব্যাংক ঋণ নেওয়া যায়?

না, সঞ্চয়পত্র ব্যাংকে জমা রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া যায় না।

অনলাইনে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার নিয়ম?

আপনি অনলাইনে সরাসরি জাতীয় সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন না। অনলাইনে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার জন্য ক্রেতার এনআইডি কার্ডের ফটোকপি, MICR চেকের ফটোকপি ও মূলকপি, ক্রেতা ও নমিনির রঙ্গিন ছবি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক ব্যতীত তালিকাভুক্ত ব্যাংকে যোগাযোগ করুন।

সঞ্চয়পত্র হারিয়ে গেলে কি করব?

সঞ্চয়পত্র হারিয়ে গেলে নিকটস্থ থানায় জিডি করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অনুসরণ করে ডুপ্লিকেট সঞ্চয়পত্র গ্রহণ করুন।

সঞ্চয়পত্র ফরম কোথায় পাবো?

জাতীয় সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার জন্য উক্ত ফরম আপনি যেখান থেকে ক্রয় করবেন তারাই আপনাকে সরবাহ করবে। যেমন, বিভিন্ন বানিজ্যিক ব্যাংক, ডাকঘর, জাতীয় সঞ্চয় বিশেষ ব্যুরোর জেলা অফিস।

শেষ কথা 

আজকে আমরা জানলাম সঞ্চয়পত্র কি? সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম সহ জাতীয় সঞ্চয়পত্র সম্পর্কে আরো বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে।

এই সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন জানতে চাইলে কমেন্ট বক্সে লিখে জানাবেন এবং ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *